লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন, প্রবাদপুরুষের বংশধর ব্যবসা করেন ছেঁড়া-ফাটা টাকার

  • By UJNews24 Web Desk | Last Updated 03-05-2022, 11:04:38:am

লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন। প্রবাদের গৌরী সেনকে কে না চেনে! শতকের পর শতক ধরে তিনি বাঙালি মননের বাসিন্দা। বঙ্গসমাজের অর্থম অনর্থম আলোচনায় অহরহ হাজির থাকেন তিনি। প্রবাদের মতোই।

এহেন প্রবাদপুরুষের এক উত্তরপুরুষ দিব্যেন্দু সেন এই কলকাতাতেই থাকেন। তাঁরও টাকা নিয়েই কারবার। তবে গৌরী সেনের মতো দানধ্যান করার ক্ষমতা নেই। অন্য উপায়ে পূর্বপুরুষের মতো বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। টাকা, সে ছেঁড়া-পোড়া হোক বা নোংরায় অচল, তাঁর কাছে আসল হলেই চালু! তাঁর ব্যবসাটাই হল, অচল নোট মেরামত করে ব্যাঙ্কে চালিয়ে দেওয়া। মাঝে ‘বাটা’ (কমিশন) হিসেবে হয় রোজগার। তবে ইদানিং এই কারবারের বাজার ভাল নয়। অনলাইন লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় টাকা অচল হওয়া নাকি অনেক কমে গিয়েছে।

গৌরী সেনের বংশধর হিসেবে পরিচিত অনেকেই আছেন উত্তর কলকাতার আহিরীটোলায়। তাঁদের অনেকেরই ছিল অচল টাকা চালানোর কারবার। কিন্তু বাজার মন্দা হওয়ায় একে একে সকলেই অন্য ব্যবসায় চলে গিয়েছেন। হাল ধরে রেখেছেন দিব্যেন্দু। বড়বাজারের সোনাপট্টিতে মনোহর দাস স্ট্রিটে এক গয়নার দোকানের টুলে বসে চলে তাঁর ব্যবসা। সেটাকেই ‘গদি’ বলেন দিব্যেন্দু। ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় বসেই ভাবেন সংসার চালাতে অন্য কিছু করার কথা। ‘লাগে টাকা’ পরিস্থিতি তৈরি হলে তিনিও ভাবেন, সত্যিই যদি একজন ‘গৌরী সেন’ পাওয়া যেত!

প্রবাদের গৌরী সেন কে ছিলেন, তা জানতে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেকে বলেন গৌরী আসলে ছিলেন এক নারী। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবি, গৌরী আসলে গৌরীকান্ত সেন। বাংলা প্রবাদ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ থেকে যা জানা যায়, তাতে গৌরী ছিলেন সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। বাবা ছিলেন নন্দরাম সেন। ১৫৮০ সালের আশপাশে গৌরীর জন্ম হয় হুগলিতে। পরে কলকাতার কলুটোলা স্ট্রিটে থাকতেন। বিভিন্ন গবেষণায় এমনটাও দাবি করা হয়েছে যে, গৌরী আসলে ছিলেন হাওড়ার বালির বাসিন্দা। কেউ আবার বলেন হুগলি বা হাওড়া নয়, গৌরীর আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এলাকায়। জন্মস্থান নিয়ে নানা মত থাকলেও গবেষকরা সকলেই এটা বলেছেন যে, কলকাতার আহিরীটোলায় বাড়ি করেছিলেন ধনী গৌরী। তাঁর ধনী হয়ে ওঠা নিয়েও রয়েছে অনেক কাহিনি। তার মধ্যে যেটা বেশি শোনা যায়, সেটি হল ব্যবসার অংশীদার বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে একটি ডুবে যাওয়া জাহাজে বোঝাই-করা দস্তা কিনেছিলেন গৌরী। কিন্তু পরে দেখতে পান আসলে দস্তার তলায় লুকিয়ে রুপো পাচার করা হচ্ছিল ওই জাহাজে। দস্তার দরে রুপো পেয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যান। ‘ঈশ্বরের কৃপায়’ পাওয়া অর্থের সবটা ভোগ না করে দানধ্যান শুরু করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য নাকি তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত, হাতও থাকত উপুড়-করা। আবার জমিদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে জেলে যাওয়া প্রজাদের রক্ষা করতেও এগিয়ে আসতেন গৌরী। একটা সময়ে লোকমুখে তাঁর দান-গৌরব ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। প্রবাদ তৈরি হয়ে যায়— ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন।’

বাপ-ঠাকুর্দার মুখে এ সব কাহিনি অনেক শুনেছেন দিব্যেন্দু। সেই সঙ্গে শুনেছেন তাঁদের পরিবারের অচল টাকার ব্যবসার ইতিহাসও। স্বাধীনতার পরে পরেই দাদু জিতেন্দ্রকুমার সেন শুরু করেন এই ব্যবসা। তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স লাগত। সাধারণ মানুষের থেকে সংগ্রহ করা নষ্ট-হওয়া নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বদলে আনার ব্যবসা। দিব্যেন্দুর বাবা অসীমকুমার সেনও একই ব্যবসা করেন। পরে দিব্যেন্দুর দাদা সন্দীপও। কাকাদের পরিবারেও ছিল এই ব্যবসা। কিন্তু একে একে সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে দিব্যেন্দু বললেন, ‘‘সবাই অন্য ব্যবসা করেন এখন। কিন্তু সব ব্যবসার মূলধন থেকে বাড়ি, গাড়ি যা হয়েছে সবই এই নোটবদলের কারবার থেকে।’’

 

 

Share this News

RELATED NEWS